বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চৌকস অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের প্রথম একক মিশন ছিল আজ। বিমানবাহিনীর ভাষায় যাকে বলে ‘সলো ফ্লাইট ট্রেনিং’।
সলো ফ্লাইট ট্রেনিং হলো একজন পাইলটের ট্রেনিংয়ের সর্বশেষ ধাপ। ফাইটার জেট অপারেট করার জন্য একজন পাইলট যে হাই স্কিল্ড, সেটিই প্রমাণিত হয় তার সলো ফ্লাইটের মাধ্যমে।
ট্রেনিংয়ের এই পর্যায়ে পাইলটকে নেভিগেটর বা কো-পাইলট বা কোনো প্রকার ইন্সট্রাক্টর ব্যতীত একাই ফ্লাইট অপারেট করতে হয়।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির আজ সে রকমই একটি ট্রেনিং ফ্লাইট অপারেট করছিলেন। এটা সফলভাবে শেষ করতে পারলে তার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর স্মৃতি হয়ে থাকত দিনটি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—যে দিনটি তার সারা জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর স্মৃতি হতে পারত, সেদিনই তিনি জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন।
জানা যায়, যেকোনো ধরনের ট্রেনিং ফ্লাইট সিভিলিয়ান এরিয়া থেকে দূরেই হয়ে থাকে। তবে সলো ফ্লাইট সাধারণত আরবান এরিয়াতেই হয়ে থাকে। আর আরবান এরিয়াতে এ ধরনের সেনসিটিভ ফ্লাইট অপারেট করার জন্য পাইলটকে যথেষ্ট কোয়ালিফাইড হতে হয়।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন বিমানটি বাঁচানোর জন্য। তিনি বিমানটির সর্বোচ্চ ম্যাক স্পিড তুলে বেসের দিকে ছুটতে থাকেন। এর মধ্যেই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে পাইলটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ঠিক এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যেই বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হয়।
এদিকে পাইলট তৌকিরের জীবনের প্রথম সলো ফ্লাইটের খবরে সকাল থেকে পরিবারের সবার মধ্যে ছিল খুশির আবহ। ফ্লাইট শেষে উদযাপনের প্রস্তুতির আয়োজন ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু নিমিষেই তার সব শেষ। দুর্ঘটনায় ঝলসে গিয়েছে তৌকিরের দেহ।
জানা গেছে, রাজশাহীর উপশহরের ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রয় ভবনে ভাড়া বাসায় থাকত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের পরিবার। তার বাবা তহুরুল ইসলাম, মা সালেহা খাতুন, বোন সৃষ্টি এবং বোনজামাই এ বাসায় বসবাস করতেন।
বাসার মালিক আতিকুল ইসলাম জানান, তৌকির ইসলাম সাগর প্রথমবারের মতো একা যুদ্ধবিমান চালাবেন জেনে পরিবারের সবাই আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। দুপুরের পর তারা বিমান বিধ্বস্তের খবর পান এবং জানতে পারেন সাগর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তখনো তারা জানতেন না তৌকির আর বেঁচে নেই।
তিনি জানান, সাগরকে দেখতে পরিবারের সদস্যরা বিমানযোগে ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে র্যাবের একটি মাইক্রোবাসে করে তাদের ভাড়া বাসা থেকে রাজশাহী শাহমখদুম বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখান থেকে তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
আতিকুল ইসলাম জানান, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের বাবা-মা, বোন এবং বোনজামাই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তার মৃত্যুর খবর জানতেন না। পরিবারের সদস্যরা মনে করেছিলেন সাগর জীবিত এবং চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট এলাকায়। তিনি রাজশাহীর ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন এবং পরে পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। এক বছর আগে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে বিয়ে করেন। তার বাবা আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন।