মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার। যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়াসংলগ্ন অঙ্গরাজ্য আলাস্কার এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন যৌথ ঘাঁটিতে মুখোমুখি বসবেন দুই নেতা। মূল আলোচ্য বিষয়—ইউক্রেন যুদ্ধ ও সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি।
ট্রাম্প বৈঠককে শান্তি প্রক্রিয়ার ‘বোঝা ও শোনা’ ধাপ হিসেবে দেখলেও ইউক্রেনকে আলোচনায় না ডাকায় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার মতে, ‘আমাদের ছাড়া কোনো শান্তিচুক্তি মানেই পুতিনের বিজয়।’ বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল ভুক্তভোগী পক্ষকে বাদ দিয়ে যুদ্ধবিরতি টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
পশ্চিমা গণমাধ্যমে খবর এসেছে—যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক ও লুহান্সক অঞ্চলকে মস্কোর নিয়ন্ত্রণাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সীমিত দাবির মাধ্যমে শুরু করে পুতিন পরবর্তীতে আরও ভূখণ্ড দাবি করতে পারেন।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প নাকি পুতিনকে বিরল খনিজের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করছেন, এমনকি আলাস্কার প্রাকৃতিক সম্পদ ও রাশিয়ার বিমানশিল্পে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের কথাও রয়েছে আলোচনায়। তবে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পুতিন রাজি না হলে ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।
ইউরোপীয় নেতারা একযোগে সতর্ক করেছেন—ইউক্রেন ছাড়া কোনো ভূখণ্ডগত সমঝোতা গ্রহণযোগ্য নয়। ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপীয় কমিশন কিয়েভের অংশগ্রহণ ছাড়া আলোচনাকে বৈধ বলে মানতে নারাজ।
সিএসআইএসের বিশ্লেষক সেথ জি জোনসের মতে, স্থায়ী শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। ইতিহাস বলে, এ ধরনের যুদ্ধবিরতির মাত্র এক–তৃতীয়াংশ দীর্ঘ মেয়াদে টেকে। তবে হাডসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো লুক কফি ট্রাম্প-পুতিন বৈঠককে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তার মতে, ট্রাম্পের কাছে একটি বিরল সুযোগ রয়েছে, যা কেবল তার ঐতিহাসিক স্থান নিশ্চিত করবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা জোরদার করবে।
এ বৈঠকের ফলাফল নিয়ে ট্রাম্পের বিশেষ দূত ও তার বন্ধু স্টিভ উইটকফ এবং রুশ প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ ইউরি উশাকভও ইতিবাচক আশা প্রকাশ করেছেন। উইটকফ বলেছেন, ‘পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে একটি দুর্দান্ত বন্ধুত্ব আছে’ এবং তিনি মনে করেন, এটি এখনো অব্যাহত থাকবে, যা বিশ্বের জন্য একটি ভালো বিষয়। অর্থাৎ, তিনি মনে করছেন—আগামীকালের বৈঠক থেকে ভালো কিছু আসতে পারে।
এদিকে রুশ বিশ্লেষকেরা এখনই এই বৈঠককে পুতিনের জয় বলে মনে করছেন। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তারা ও বিশ্লেষকেরা শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। রাশিয়া যদিও আলাস্কা বৈঠককে প্রতীকীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করছে। রুশ বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্পই প্রথমে পিছিয়ে গেছেন।
রাশিয়ার প্রভাবশালী ব্লগার ইউরি পদোলিয়াক বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে, ভ্লাদিমির পুতিন কূটনীতিতে এক অনন্য মাস্টারক্লাস প্রদর্শন করেছেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে, যে বৈঠকটি আলাস্কায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং তাতে জেলেনস্কি ও তার ইউরোপীয় সমর্থকেরা নেই—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক জয়।’
একই ধরনের মনোভাব পোষণ করেন পুতিনের ঘনিষ্ঠ কূটনীতিক ইউরি উশাকভ। তিনি বলেন, ‘আলাস্কা ও আর্কটিক অঞ্চলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থগুলো মিলিত হয় এবং এখানে বৃহৎ পরিসরের পারস্পরিক উপকারী প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়।’
সব মিলিয়ে, আলাস্কার এই বৈঠক আপাতদৃষ্টিতে শান্তি আলোচনার সুযোগ হলেও এটি ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও কৌশলগত লাভ–ক্ষতির জটিল সমীকরণ। ফল যা–ই হোক না কেন, বৈঠকটি ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।